সকাল ৮টা
অ্যালার্ম ঘড়ির প্রচণ্ড বিরক্তিকর শব্দে ঘুম ভাঙল মোহনার। বিছানায় শুয়ে থেকে পুরো ঘরটার ওপর একবার চোখ বুলিয়ে নিল সে। এটা তার রোজকার অভ্যাস। মাথার উপর সিলিং ফ্যানটা ধীরে ধীরে ঘুরছে, মাথার পাশে একটা মাঝারি সাইজের টেবিল আর তার উপর স্তুপ করে রাখা একগাদা ক্রিমিনাল ল’ এর বই, আর পাশে বাংলাদেশের সংবিধানের একটা কপি। দরজার কাছে একটা বিশাল আয়না লাগানো ড্রেসিং টেবিল আর তার উপর মেকআপ সামগ্রীর ছড়াছড়ি। কাঠের আলমারিটার একটা পাল্লা খোলা, হাতলে অন্তর্বাস ঝুলে আছে।
ছোট্ট একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল মোহনা। মানুষ ভাবে যারা ল’ এ পড়ে তারা খুব গোছানো স্বভাবের হয়ে থাকে, অনেকের নাকি শুচিবায়ুও হয়। কিন্তু তারা নিশ্চয়ই মোহনাকে দেখেনি। সবেমাত্র তেইশে পা রেখেছে, এমনিতে তেমন কিছু নেই সমস্যা তবে এই একঘেয়ে জীবনে কিছুটা রং খুজে বেরোয় সে। আর একাকীত্ব তার সয়না। ভালোবাসা খুঁজে বেরোয় সে। আর যাকে ভালবাসে, মন থেকেই বাসে। কেন জানি আজকাল ভালোবাসার কদর কমে গেছে দুনিয়ায়। ধোঁকা ছাড়া দেবার মত যেন আর কিছুই নেই কারো কাছে। তবে তার বান্ধবীদের ধারণা ভিন্ন তারা ভাবে সমস্যা ছেলেদের মধ্যে না, অন্য কোথাও। আর তাই তারা প্রায় জোর করেই মোহনাকে স্থানীয় এক সাইকায়াট্রিস্টের কাছে অ্যাপয়ন্টমেন্ট নিয়ে দিয়েছে। মোহনা প্রথমে রাজি না হলেও পরে কৌতূহল হল। যাবার কথা আজ, ১০টায়।
সকাল ১০টা
মোহনা গুলশান-২ চত্বরের সামনে একটা বহুতল ভবনের সামনে দাড়িয়ে আছে। একটু ইতস্তত করে ভিতরে ঢুকে রিসেপশনে যেয়ে বলতে তাকে কিছুক্ষণ লবিতে অপেক্ষা করতে বলা হল। লবিটা সুন্দর, সাজানো। দেয়ালগুলো হালকা সবুজ রং করা, আর আসবাবপত্র একটু গোলাপি গোলাপি। সে কোথায় যেন পড়েছে যে সবুজ আর গোলাপি রং মানুষের মনকে শান্ত করে। হয়ত এটা ভেবেই অপেক্ষা করার জায়গাটাকে এভাবে রং করা হয়েছে। টেবিল থেকে একটা ম্যাগাজিন নিয়ে পাতা ওলটাতে লাগল মোহনা। মাঝখানে একটা সেলফি তুলে ফেসবুকে আপলোড ও করল,- ক্যাপশনঃ Wasting time like a pro.
‘লবিতে বসে ছবি তোলা নিষেধ জানেন তো?’
কথাটা শুনেই চমকে পিছনে তাকাল মোহনা। হাত থেকে ফোনটাও পড়ে গেল। সুদর্শন এক যুবক দাড়িয়ে ছিল তার সামনে। বয়সে তার থেকে খুব একটা বেশি বড় হবেনা। ব্লু-জিন্স, পোলো টি-শার্ট, হাতে কয়েকটা রাবার ব্যান্ড পরা......
‘দুঃখিত। আপনাকে ভয় পাইয়ে দিতে চাইনি। নিন, আপনার ফোন, মিস...?’ ছেলেটি ফোন বাড়িয়ে দিতে দিতে বলল।
‘মুহু, সরি, মানে মোহনা। মোহনা।’ এমন অপ্রস্তুত হওয়ার জন্য মনে মনে নিজেকেই গালি দিল। ‘হাই।’
‘হাই মিস মুহু সরি মানে মোহনা :P আমি ফারাবি।’ একটু হেসে বলল। ইশশ! হাসিটা কি সুন্দর মোহনা ভাবে। ‘আপনি কি এখানে নতুন?’ ফারাবি প্রশ্ন করে।
‘জী। আজই প্রথম এখানে আমি। আপনি?’
‘আমি গত এক মাস হল আসছি।’ এমন সুদর্শন ছেলের আবার কি মানসিক সমস্যা থাকতে পারে তাই মনে মনে ভাবছিল মোহনা। ‘এনিওয়ে, চলি তাহলে মিস মোহনা। আবার দেখা হবে, শুভ সকাল।’
‘আপনাকেও।’ মোহনা ফারাবির চলে যাওয়া পথের দিকে তাকিয়ে থাকে। জীবনটা কোন উপন্যাস হলে এই সময় হয়ত রবীন্দ্রসঙ্গীত বাজত ব্যাকগ্রাউন্ডে।
প্রেমে প্রাণে গানে গন্ধে আলোকে পুলকে
প্লাবিত করিয়া নিখিল দ্যুলোকে-ভুলোকে
তোমার অমল অমৃত পড়িছে ঝরিয়া।
দিকে দিকে আজি টুটিয়া সকল বন্ধ
মুরতি ধরিয়া জাগিয়া উঠে আনন্দ;
জীবন উঠিল নিবিড় সুধায় ভরিয়া।
তবে জীবন কোন উপন্যাস নয়। তাই রবীন্দ্রসঙ্গীত এর বদলে রিসেপশনের বেল বেজে উঠল। তার সিরিয়াল এসে গেছে। দেখা যাক কি হয়!
সকাল ১০টা ২০মিনিট
ভদ্রমহিলা ঠিক মোহনার মুখোমুখি সোফায় বসে আছেন। মুখে একটা আন্তরিক আন্তরিক ভাব। টেবিলের ওপর দু’কাপ চা এনে রাখলেন। একটা কাপ মোহনার দিকে এগিয়ে দিয়ে নিজেরটা তে চুমুক দিতে দিতে বললেন, ‘হ্যাঁ ডিয়ার। তাহলে শুরু করা যাক। টেল মি অ্যাবাউট ইউ।’
মোহনা কিছুক্ষন চুপ করে থাকে। ভদ্রমহিলাকে দেখে মোটেও কোন সাইকায়াট্রিস্ট মনে হচ্ছে না। ডাক্তাররা তো এত আন্তরিক টাইপের হয় না। কিংবা কে জানে হয়ত সাইকায়াট্রিস্টরা এমনই হন। ঘরটা বেশ বড়, সিলিঙগুলো উচু উচু। এই ঘরটা একটু অন্ধকার অন্ধকার। হয়ত অন্ধকারে মানুষ তার মনের কথা ভাল করে বলতে পারে। দেয়ালে একটা মাঝারি সাইজের পেইন্টিং, একটা বাচ্চা মেয়ের, চোখ থেকে এক ফোঁটা অশ্রু পড়বে পড়বে এমন ভাব।
‘ওয়েল, আমি জানিনা আমার আদৌ কোন সমস্যা আছে কিনা। আমি আসলে আমার ফ্রেন্ডদের জোরাজুরিতেই এসেছি। ঠিক বুঝতে পারছিনা...’
‘কোন সমস্যার কথা বলতে হবেনা ডিয়ার। তুমি বলো তোমার বান্ধবীদের কথা। তারা কেন মনে করে তোমার সাহায্যের প্রয়োজন?’
‘তারা মনে করে যে আমি হয়ত কোন আমম... মানসিক চাপের কারণে বা অন্য কোন কারণে হয়ত ছেলেদের তেমন ট্রাস্ট করতে পারিনা। মানে কোন রিলেশন টিকিয়ে রাখতে পারিনা, মানে...’ মোহনা ইতস্তত করে।
‘আই সি।’
‘কিন্তু তাদের ধারণা ঠিক নয়। আমি যদি কারো দ্বারা প্রতারিত হই সেটা কি তবে আমার দোষ? আমিতো চাইই সম্পর্কটা টিকিয়ে রাখতে, আমিতো চেষ্টার কোন কমতি করিনা। তবে কেন শুধু আমার সাথেই এমন হয়? কেন আমি শান্তিতে থাকতে পারিনা? আমার কপালে কি ভাল কেউ জুটবেনা কখনো??’ মোহনার গলা ধরে আসে কথা বলতে বলতে।
‘ওয়েল ডিয়ার, তোমার কপালে কি আছে আমিতো আর তা জানিনা। কিন্তু আমি তোমার বান্ধবীদের সাথেও একমত নই। আমার মনে হয়না সমস্যাটা কোন একটা সম্পর্ক টিকিয়ে রাখার ব্যপারে। বরং হয়ত সমস্যাটা অন্য কোথাও।’ আরও এক চুমুক দিলেন তিনি চায়ে।
‘অন্য কোথাও?’
‘হুমম। তুমি কি কখনো ভেবে দেখেছ যে হয়ত সমস্যাটা তোমারই। তুমি সবসময় ভুল ছেলেকে পছন্দ করে বসো। তোমার সঙ্গী পছন্দের ক্ষেত্রে দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে হবে।’
‘আমি ভুল ছেলে পছন্দ করি?! আর সেটা আমার দোষ?’ মোহনা চোখ বড়বড় করে প্রস্ন করে। গলায় ক্রোধ স্পষ্ট।
‘হ্যাঁ ডিয়ার। তবে চিন্তা করোনা। কয়েকটা সেশনে থেরাপি নিলেই তুমি এই মনোভাব কাটিয়ে উঠতে পারবে।’ ভদ্রমহিলার মুখে হাসি অক্ষুন্ন।
‘টু হেল উইথ ইউর থেরাপি!’ মোহনা উঠে দাড়ায়। রাগে কাঁপতে কাঁপতে বলে, ‘আমার এখানে আসাই ভুল ছিল! আমি কাউকে পছন্দ করব আর সে খারাপ হবে আর সেটা আমার দোষ?! কে আপনাকে সাইকায়াট্রিস্ট বানিয়েছে? নকল সার্টিফিকেট নিয়ে তামাশা করতে বসছেন! সবগুলোর ওপর কেস করব আমি! যত্তসব!’
মোহনা বের হয়ে আসে।
রাত ৮টা
ওয়েস্টিন।
মোহনার মেজাজ তখনও চড়া। সারাদিন ওই সাইকায়াট্রিস্টের কথাটাই মাথার মধ্যে বারবার ঘুরছে। ‘তুমি ভুল ছেলে পছন্দ কর’! আর তাই সে ঠিক করল বাইরে বেরোবে, ওয়েস্টিনে ডিজে পার্টির কথা শুনে এখানেই চলে আসল। একটু গান-বাজনার মধ্যে থাকলে হয়ত ওই বুড়ির কথা আর মনে হবেনা।
আজ ইচ্ছেমত সেজেছে। গাড় লাল একটা গাউন এর সাথে গোল্ড ইয়াররিংস মানিয়েছেও বেশ। বঙ্কিমচন্দ্র তাকে সে সময় দেখলে হয়ত বলেই বসতেন, “এ মূর্তি লীলালাবণ্যাদির পরিপাট্যে যেন হৃদয়মধ্যে বিষধরদন্ত রোপিত করে”
ভালই সময় কাটছিল, আর তখনই ভিড়ের মধ্যে এক পরিচিত চেহারা দেখল সে। হ্যাঁ, ফারাবিই তো। মোহনা চোখের ইশারায় ডাকল তাকে। ওই তো, ফারাবি ভিড় ঠেলে এগিয়ে আসছে, চোখ দুটো কেমন উজ্জ্বল। মোহনার হাই বলার আগেই ফারাবি বলতে শুরু করল,-
‘তার রূপের আলো সকালবেলার সূর্য ওঠার মত।
আঁধার রাতেও আসে যদি, দিনের আলো দেখি।
দেহটা কি সূর্যকণায় গড়া?
মরি মরি, ধার করা রহস্যের ওড়নায় ঢাকা,
তার চোখের হাসির ঝিলিকে,
নিরন্তর বন্দী হয়ে আছে বুঝি চাঁদ।’
ইশশ!! কত সুন্দর করে আবৃতি করে! মোহনা হেসে ফেলে। ‘হাহাহা, ধন্যবাদ মিস্টার। তবে একটু চিজি ছিল কিন্তু। হাহাহা।‘
ফারাবি আবার বলতে শুরু করে,
‘একটি হাসির তরে আমি বিশ্ব দিতে পারি,
যদি আমি ভাঙতে পারি তোমার জুরিজারি।
তোমার মুখে একটি কথা শুনতে যদি পাই,
মাটির পরে হাঁটবে রাজা অন্যথা তার নাই।
রাজাদের সব টুটবে মুখের বাঁধ,
তোমার যদি হাঁটার জাগে সাধ।
খুশ করতে পারলে তোমায়,
থাকব তোমার পায়ের তলায়;
তোমায় যদি হারাতে হয় ভাসব আঁখি লোরে।
বিশ্বটাকে ছাড়তে পারি একটি চুমুর তরে।’
ফারাবির চোখে বা বচনভঙ্গিতে এমন কিছু ছিল যা মোহনাকে এক অজানা মোহে আবদ্ধ করে রেখেছিল। চারপাশের শব্দগুলো বহুদুরে ভেসে যেতে যেতে একসময় স্তব্ধ হয়ে গেল। রক্তবর্ণ ওষ্ঠাধরা দুটি ঈষৎ ফাক হয়ে গেল, ধীরে ধীরে স্পর্শ করল একে অপরের ঠোঁট...
সকাল ৮টা
আজ কোন অ্যালার্ম বাজেনি, তবু ঘুম ভাঙল মোহনার। অপরিচিত ঘরটার উপর চোখ বোলালো সে। ছিমছাম, তবে সাজানো গোছানো। টেবিল, আলমারি, মাঝারি সাইজের আলনা সবই আছে। শুধু ড্রেসিং টেবিল নেই। দেয়ালে একটা অ্যাবসট্রাক্ট ছবি টানানো, একটা ডাবল বেড, একপাশে মোহনা, আর... আর অপর পাশে ফারাবি।
কি সুন্দর সেই অনুভূতি! মোহনা চোখ বন্ধ করে গত রাতের আনন্দময় মুহূর্তগুলোর কথা মনে করতে লাগল।
‘হেই। ঘুম ভাঙল?’ ফারাবি প্রস্ন করে। হাসি হাসি মুখ।
‘হুম। গুড মর্নিং।’
‘ফ্রেশ হয়ে নাও তুমি। আমি ব্রেকফাস্টের ব্যবস্থা করি।’
‘আমি কিন্তু কফি খাই।’ মোহনা বলে।
‘জানি আমি। তাও আবার তিন চামচ চিনির সাথে।’ ফারাবি হাসে।
‘হেই, তুমি কিভাবে জান?’ মোহনা অবাক হয়ে প্রস্ন করে।
‘কাল রাতে পার্টিতে বলেছিলে একবার কথায় কথায়।’ ফারাবির উত্তর।
‘আমি বলেছি আর তোমার মনেও আছে?’
‘আমার স্মৃতিশক্তি একটু ভাল।’
মোহনার অনেক ভাল লাগে! কি কেয়ারিং! শেষ পর্যন্ত হয়ত সে পেয়ে গেছে যাকে সে খুঁজছিল এতদিন। ইচ্ছে হচ্ছে এখনই ওই সাইকায়াট্রিস্টের কাছে যেয়ে তাকে দেখিয়ে দিয়ে আসতে যে সে ভুল ছেলে পছন্দ করেনা! :D আর তখনি তার মনে পরল,-
‘কালকে রাতে তো আমরা অনেক বিষয় নিয়েই কথা বলেছি ফারাবি, একে অপরের সম্বন্ধে অনেক কিছুই জানি। কিন্তু দেখ আসল কথাটাই জানিনা, হাহাহা।’
‘কি সেটা?’
‘এই যে তুমি সাইকায়াট্রিস্টর কাছে কেন যাও?’ মোহনা জানতে চায়।
‘ওহ ওটা। আসলে ডক্টর এখনও বলতে পারছেন না যে আমার সমস্যাটা সাইকোলজিকাল না নিউরোলজিকাল। অনেক টেস্ট করতে দিয়েছেন। আসলে আমার কোন মেয়ের সাথে একরাত কাটানোর পর তাকে আর ভালোলাগেনা। কোন আগ্রহ থাকেনা। এবং এজন্য আমার একটু খারাপও লাগে। এই আমার সমস্যা।’ ফারাবি বলল। ‘আর তুমি? তোমার সমস্যা কি?’
কয়েক সেকেন্ড দীর্ঘ নীরবতা, তারপর,-
‘I pick the wrong men.’ সিলিং ফ্যানটার দিকে তাকিয়ে থেকে মোহনা বলল। তবে কথাটা সে ফারাবিকে বলল না নিজেকে বলল, তা বোঝা গেলনা।
________________________________________
বিঃদ্রঃ এখানে ব্যবহার করা কবিতার লাইনগুলো সহস্র এক আরব্য রজনী বইটা থেকে নেয়া।
বিঃদ্রঃ২ গল্পটা একান্তই কাল্পনিক, কাউকে উদ্দেশ্য করে লেখা না। তারপরেও কারো সাথে মিলে গেলে আমার দোষ নাই। :3
‘ভালোবাসা তারই সাজে হিসাব যে-জন জানে,
বোকা মেয়ের বোকা প্রেম মৃত্যু ডেকে আনে।’